চুম্বক হলো এমন একটি বস্তু যা বিশেষ আকর্ষণ ক্ষমতাসম্পন্ন। চুম্বকের এই ক্ষমতাকে চুম্বকত্ব বলা হয়। চুম্বকের চুম্বকত্বের কারণে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। এই চৌম্বকক্ষেত্র অদৃশ্য, কিন্তু এর মাধ্যমেই চুম্বকের প্রায় সব ধর্ম প্রকাশ পায়!
বৈশিষ্ট্য জানার কোনো সুযোগ ছিলনা, বিজ্ঞানীরা তখনও মানতেন যে চুম্বক এবং চৌম্বক পদার্থ যে খেল দেখাচ্ছে তার সাথে তড়িতের কোনো না কোনো সম্পর্ক রয়েছে। চৌম্বকবলরেখা সম্পর্কে সবচেয়ে পরিচিত ছবিটির ব্যাখ্যা দেয়া যাক।
একটি দণ্ড চুম্বক। এর উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরু নামক দুটি মেরু রয়েছে। সর্বজনস্বীকৃত বিধান অনুযায়ী বলবো উত্তর মেরু থেকে চৌম্বকবলরেখা নামক কিছু রেখা বেরিয়ে দক্ষিণ মেরুতে প্রবেশ করছে। তড়িতের ক্ষেত্রে যেমন সর্বদা ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্ত থেকে ঋণাত্মক প্রান্তের দিকে প্রবাহের দিক ধরা হয় তেমনই একটি ব্যাপার।
এক্ষেত্রে দুটি বিষয় লক্ষণীয়, প্রথমত এই রেখাগুলো হচ্ছে বলরেখা বা শক্তিরেখা অর্থাৎ কোনো এক প্রকার শক্তির সূচনা হচ্ছে একটি প্রান্তে এবং সমাপ্তি অপর প্রান্তে। দ্বিতীয়ত, শক্তিরেখাগুলো এলোমেলোভাবে না ছড়িয়ে একটি নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করছে। কিন্তু গতিপথের চেহারা ঠিক এরূপই কেন? উত্তর দেবার আগে একটু পরমাণু জগতে ঢুঁ মারি।
বেশ, একটি ইলেকট্রন এবং একটি প্রোটন এরুপ দূরত্বে থাকলে একে অপরকে আকর্ষণ করবে, এবার চুম্বকের পোলের দিকে খেয়াল করিঃ-
একটি উত্তর মেরু এবং একটি দক্ষিণ মেরু এর মধ্যে ঠিক একই রূপ আকর্ষণ বিদ্যমান। এখনঃ
চার্জ দুটির আশেপাশে কোথাও একটি ধনাত্মক আধান রেখে আমরা তার ওপর চার্জ দুটির প্রভাব যদি খেয়াল করি তবে দেখব ধনাত্মক আধানটি প্রোটনের বিকর্ষণ বলের দিক এবং ইলেকট্রনের আকর্ষণ বল,দুই বলের লব্ধি বলের দিকে ভ্রমন করছে।
এখন একটি শক্তিশালী দণ্ড চুম্বকের পাশে আমরা যদি বিভিন্ন অবস্থানে একটি চুম্বক শলাকাকে স্থাপন করি তবে স্বাভাবিকভাবেই শলাকা এবং চুম্বকের সম পোলগুলোর মধ্যে আকর্ষণ এবং বিপরীত পোলগুলোর মধ্যে বিকর্ষণের ফলে লব্ধি বলের দিকে শলাকা অবস্থান নেবে। এখন শলাকার যে কোনো একটি পোলের অবস্থানের গতিপথ যদি আমরা যোগ করে দিই তবে সেই আকাঙ্ক্ষিত বলরেখার পথটিই পাবো।
ব্যাপারটি আরও পরিষ্কার হবে যদি আমরা বলরেখা বা magnetic line of flux বা magnetic line of force এর তাত্ত্বিক সংজ্ঞাটি খেয়াল করিঃ-
“যখন একটি বিচ্ছিন্ন একক চুম্বক মেরু(হয় উত্তর অথবা দক্ষিণ) একটি চুম্বক ক্ষেত্রে রাখা হয়, এটি আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ উভয় বল অনুভব করে, বিপরীত এবং সমমেরুর প্রভাবে, দুটি বলের লব্ধি বলের কারণে মেরুটি একটি পথে ভ্রমন করবে, সেই পথের নামই চৌম্বকবলরেখা। এরকম অসংখ্য পথকে সম্মিলিতভাবে magnetic flux বলা যায়।”
এই সংজ্ঞার মধ্যে একটু ঘাপলা আছে যা পরে ব্যাখ্যা করছি।
আমরা যদি উপরের ছবির প্রতিটা অবস্থানে একক মেরুটি বসিয়ে তার গতিপথ গাণিতিকভাবে নির্ণয় করতাম তবে ছোট ছোট যেই অভিক্ষেপগুলো পেতাম তার যোগফল হল একটি রেখা। তাই বলা যায় মেরুটি রেখা বরাবর যাত্রা করেনা বরং তার যাত্রাপথের ওপর লক্ষ করেই রেখাটি আঁকা হয়েছে।
এই বলরেখাগুলোর কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছেঃ-
(১)বলরেখার দিক ধরা হয় উত্তর মেরু থেকে দক্ষিনের দিকে।
(২)বলরেখাগুলো একে অপরকে ছেদ করেনা।
(৩)বলরেখাগুলো বদ্ধ লুপ বা প্যাঁচ তৈরি করে। ইলেকট্রন-প্রোটনের সাথে তুলনা বা analogy দেয়ার সময় আমরা একটি একক মেরুর সাথে একক চার্জের মিল পেলেও চার্জ এবং পোলের মধ্যে যেই সুস্পষ্ট পার্থক্যটি রয়েছে তা হল একক অস্তিত্ব। একক চার্জ খুবই সাধারণ একটি বিষয় হলেও বাস্তবজগতে একক মেরু বলে কিছু নেই, এটি একটি গাণিতিক ধারণামাত্র। ফলস্বরূপ একটি একক চার্জের চারিদিকে তার যে শক্তিরেখা তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে।যেমনঃ
কিন্তু একক মেরু বলতে যেহেতু কিছুর অস্তিত্বই নেই তাই চুম্বকের শক্তিরেখা আবদ্ধ। প্রশ্ন হতে পারে চুম্বককে দুভাগ করলেই তো হয়? তখন যা হয়:
অর্থাৎ ভগ্ন অংশ নিজেই আরেকটি স্বকীয় চুম্বকে পরিণত হয়। তখন এক মেরু থেকে যেই শক্তিরেখা বের হয় তা চারিদিকে না ছড়িয়ে বিপরীত মেরুর দিকে আকৃষ্ট হয়। একারণে চৌম্বকবলরেখা বদ্ধ হয়।
(৪) বলরেখাগুলো স্থিতিস্থাপক ইলাস্টিকের মত আচরণ করে।মোট কথা,বলরেখার স্থিতিস্থাপক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিপরীত মেরুর মধ্যে আকর্ষণ আর সমমেরুর বিকর্ষণের ব্যাখ্যা দেয়া যায় এইভাবেঃ-
ধরা যাক উত্তর মেরু থেকে কিছু রেখা দক্ষিণ মেরুতে প্রবেশ করল। স্থিতিস্থাপক বস্তুর ধর্ম হল টানলে সরণের বিপরীত দিকে একটি বলের সৃষ্টি হয়, তাই পোল দুটি দূরত্ব কমিয়ে স্থিত অবস্থা লাভের চেষ্টা করে।
যেহেতু সমপোল হতে বলরেখা সমপোলে প্রবেশ করবেনা এবং একটি রেখা আরেকটিকে ছেদ করবেনা বা আরেকটির অভ্যন্তরে ঢুকে যাবেনা তাই দুটি বিপরীত পোল কাছাকাছি আনলে অনেকটা সঙ্কুচিত রাবার ব্যান্ডের মত অবস্থা সৃষ্টি হয় যা প্রসারিত হয়ে স্থিত অবস্থায় আসতে চায়, ফলে বিকর্ষণ বলের সৃষ্টি হয়।
চলমান চার্জের চৌম্বকীয় ধর্মঃ-
চৌম্বকবলরেখা ব্যাখ্যা করার সময় একটি দণ্ড চুম্বকের চারপাশে বিভিন্ন অবস্থানে রেখে চুম্বক শলাকা রেখে প্রভাব দেখা হয়েছিল। দণ্ড চুম্বকের বদলে যদি ওখানে কিছু চার্জ রাখা হত তবে শলাকায় কোনো বিক্ষেপ হতনা। তবে সেই চার্জগুলোই চলমান অবস্থায় থাকলে তার চারপাশে একটি চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হত যার কারণে শলাকা বিক্ষেপ দেবে। আমরা চৌম্বকক্ষেত্রকে সংক্ষেপে B বলব। এই ব্যাপারটি প্রথম ব্যাখ্যাসহ প্রমান করেন Oersted নামক একজন অসাধারণ বিজ্ঞানী।
চিত্রঃ একটি বর্তনীতে প্রবাহের দরুন সৃষ্ট B শলাকার বিক্ষেপ ঘটাচ্ছে।
এখানে দুটো জিনিস রয়েছে, একটি বদ্ধ বর্তনী এবং একটি চুম্বক। এইযে তড়িৎ প্রবাহের ফলে একধরনের চৌম্বকত্ব সৃষ্টি হল,একেই বলে তড়িৎচুম্বক বা electromagnet। যদি পরিবর্তনশীল বা alternating current(A.C) ব্যবহার করা হয় তবে B এর মান এবং দিক দুটিই পরিবর্তিত হবে।
তার ১২ বছর পর বিজ্ঞানের আরেক দিকপাল মাইকেল ফ্যারাডে বলেনঃ-
“যখন কোনো বদ্ধ তার কুণ্ডলীতে আবদ্ধ চৌম্বক আবেশরেখার সংখ্যা বা ফ্লাক্সের পরিবর্তন ঘটে তখন উক্ত বর্তনীতে একটি তড়িচ্চালক শক্তি আবিষ্ট হয়।”
এটি তড়িৎচুম্বকীয় আবেশের প্রথম সূত্র হিসেবে বিখ্যাত।
উপরের সূত্র দুটির সম্পর্কের ব্যাপারে বলা যায়, অনেকটা এরকম, দিনের শেষে রাত আসবে আর রাতের শেষে দিন। তড়িৎ প্রবাহ থেকে চুম্বক পাব আর চুম্বক থেকে তড়িৎ। ফ্যারাডের প্রথম সূত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বর্তনী ও চুম্বকের মধ্যে আপেক্ষিক গতি থাকতে হবে তবেই তড়িৎ উৎপন্ন হবে, গতির ফলে প্রতি মুহূর্তে কুণ্ডলী দিয়ে অতিক্রান্ত ফ্লাক্স সংখ্যার ভিন্নতা ঘটবে, গতি যদি না থাকে তবে অন্য কোনো উপায়ে প্রতি মুহূর্তে ফ্লাক্স সংখ্যার ভিন্নতা ঘটাতে হবে(সেটি কি হতে পারে?!)। উৎপন্ন তড়িচ্চালক শক্তি ফ্লাক্সের পরিবর্তনের হারের সমানুপাতিক হবে। এই ব্যাপারটিকে বলা হচ্ছে তড়িৎচুম্বকীয় আবেশের দ্বিতীয় সূত্র।
বেশ পরিচিত এই সূত্র দুটি উল্লেখ করলাম যেই কারণে সেখানে এখন আসছি।
বেশ বহুল পরিচিত একটি সূত্র এটি, তড়িৎ প্রবাহের দিকে ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল দিলে বাকি আঙ্গুলগুলো উৎপন্ন B এর দিক নির্দেশ করে।
যদি একটা কাগজের তল বরাবর ওপরের দিকে তড়িৎ প্রবাহিত হয় তবে উৎপন্ন B এর দিক এমন হবে যেন পরিবাহীর ডান পাশের কাগজ ফুঁড়ে উপরে উঠছে এবং বাম পাশের কাগজে ঢুকে যাচ্ছে।
এখন কথা হচ্ছে ডান হাতের প্যাঁচ অনুসরন করে B উৎপন্ন হয়নি কাকতালীয়ভাবে দেখা গিয়েছে যে একটি পরিবাহীর মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহিত হলে যেভাবে B উৎপন্ন হয় তা আঙ্গুলের ওরকম অবস্থানের সাথে মিলে যাচ্ছে।
বেশ, আমরা এখন বিপরীত দৃশ্যটি দেখার চেষ্টা করি।একটি বদ্ধ বর্তনীতে B প্রয়োগ করা হবে এবং প্রবাহের দিক কোনো দিকে হওয়া উচিত তা দেখবঃ
উপরের চিত্রে কুণ্ডলীর ভেতরে B প্রয়োগ করা হচ্ছে(কাগজের তলের ভেতর থেকে আমাদের দিকে), কুণ্ডলীটি পুরোপুরি দ্বিমাত্রিক কাগজ তলে অবস্থিত, যে কোনো একদিকে তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টি হবে, তার দরুন পরিবাহীর নিজস্ব একটি ক্ষেত্রও সৃষ্টি হবে।যদি প্রথম কেসটি সত্য হয় তবে প্রবাহের দরুন প্রয়োগকৃত B এর মতই উৎপন্ন B এর দিক হবে প্রথমত কাগজ ফুঁড়ে আমাদের দিকে, ঠিক তখন দুটি ক্ষেত্র একই দিকে ক্রিয়াশীল, সম্মিলিত ক্ষেত্র প্রবাহ আরও বাড়াবে, প্রবাহ আবার নিজস্ব B বাড়াবে এভাবে কুণ্ডলীর মধ্যে একটি সর্বদা চলমান অস্থিতিশীল সিস্টেমের উদ্ভব ঘটবে যা শক্তির নিত্যতার সূত্রকে ভাঙবে।
তাই এমন একদিকে প্রবাহ সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন যার নিজস্ব ক্ষেত্র প্রয়োগকৃত ক্ষেত্রকে কমানোর চেষ্টা করবে, দ্বিতীয় চিত্রটি সঠিক কিনা তা পাঠক বিচার করুন।
লেনজ নামক অসাধারণ এক বিজ্ঞানী এই ব্যাপারটি প্রথম ব্যাখ্যা করেন। লেঞ্জের সূত্রটি হলঃ
“আবিষ্ট তড়িচ্চালক শক্তি বা তড়িৎ প্রবাহের দিক এমন হয় যে এটি উৎপন্ন হবার মুল কারণের বিরোধিতা করে।”
ভেক্টরের ক্রস গুননের ব্যাপারটি আমরা জানি, দুটি ভেক্টর রাশির ক্রসগুননের ফলে উভয়ের লম্ব বরাবর আরেকটি ভেক্টর উদয় হয়। প্রথম ভেক্টর থেকে দ্বিতীয় ভেক্টরের দিকে একটি স্ক্রু ঘুরালে সেটি যেদিকে যায়, উৎপন্ন ভেক্টরের দিক সেদিকে।
এখানে ডান হস্ত সূত্র নামক একটি ব্যাপার আছে, যদি ডান হাতের তর্জনী প্রথম ভেক্টর, মধ্যমা দ্বিতীয়টি হয় তবে বৃদ্ধাঙ্গুলি লব্ধি ভেক্টরের দিক বলবে, যে কোনো ভাবে আমরা দিকটি বের করতে পারি।
এতক্ষণ আমরা হয় তড়িতের প্রয়োগে চুম্বক বা চুম্বকের কারণে তড়িৎ এরূপ ব্যাপার দেখছিলাম।তড়িৎ হল চার্জের প্রবাহ যা একটি ভেক্টর রাশি আবার চুম্বকক্ষেত্রের নির্দিষ্ট দিক থাকায় সেটিও ভেক্টর রাশি,ফলস্বরূপ দুটি একসাথে কাজ করলে আরেকটি ভেক্টর রাশির উদয় ঘটবে উভয়ের লম্ব বরাবর। যা একটি বল, প্রকাশ করা হয়ঃ-
F=qVxB=qVBsin(angle)
এখানে q একটি ধনাত্মক চার্জ, যার বেগ v,B হল প্রয়োগকৃত ক্ষেত্র। ব্যাপারটি হল একটি চুম্বকক্ষেত্রে একটি আধান ক্রিয়াশীল থাকলে তা একটি বল অনুভব করবে, বলের দিক পাব ডান হস্ত সূত্র থেকে। অবশ্য চার্জটি যদি ঋণাত্মক হয় তবে ডান হস্তের বদলে বাম হস্ত সূত্র ব্যবহার হবে।তখন বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি বলের দিক বোঝাবে। চিত্রে কাগজের বাইরে বেরিয়ে আসা ক্ষেত্র ও ভেতরে প্রবেশ করা ক্ষেত্রের জন্য উদ্ভূত বল F এর দিক দেখানো হয়েছে।